হাওজা নিউজ এজেন্সি, ইসলামী চিন্তাধারায় সংযম শুধু একটি সাধারণ পরামর্শ নয়, বরং এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নীতি। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) "দুয়া মাকারিমুল আখলাক"-এ সংযমের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন, আর আমিরুল মুমিনিন (আ.) জীবনযাপন ও ইবাদতে এটিকে অপরিহার্য বলে অভিহিত করেছেন। এই সোনালী নীতি সাধারণ আচার-আচরণ যেমন হাঁটা ও কথা বলা থেকে শুরু করে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর ওপরও প্রভাব বিস্তার করে।
সংযম: ইসলামী শিক্ষার পথ ও সফলতার চাবিকাঠি
প্রখ্যাত নৈতিকতা বিশেষজ্ঞ প্রয়াত আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলী নাসেরী, তার নৈতিক শিক্ষার এক বক্তৃতায় “সংযম: ইসলামী শিক্ষায় সফলতার পথ” শিরোনামে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তার দোয়ায় উল্লেখ করেন:
"اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَی مُحَمَّدٍ وَ آلِهِ وَ مَتِّعْنِی بِالاقْتِصَادِ"
এই বাক্যে ইমাম (আ.) আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন যেন তিনি মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারকে দোয়া প্রদানের পর জীবনের সব ক্ষেত্রে সংযম অবলম্বনের তৌফিক দান করেন।
ইসলামী দৃষ্টিকোণে "ইকতিসাদ" বা সংযম
ইসলামী সংস্কৃতিতে "ইকতিসাদ" শব্দটি আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে আরও গভীর অর্থ বহন করে। আধুনিক ফারসি ভাষায় এটি প্রধানত অর্থনীতি ও আর্থিক বিষয়ে ব্যবহৃত হলেও, আরবি ভাষা ও ইসলামী শিক্ষায় এটি জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে সংযম ও ভারসাম্যের প্রতীক।
সংযম: কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি
কুরআন মাজিদে সুরা লুকমানে, এই মহান হিকমতের অধিকারী পিতা তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেন:
"وَاقْصِدْ فِی مَشْیِکَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِکَ"
এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, হাঁটার ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। হাঁটার সময় অহংকারপূর্ণ গতি যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনই অলস ও দুর্বলভাবে চলাফেরা করাও অনুচিত।
সংযম: কথাবার্তায় ভারসাম্য
একইভাবে, কথোপকথনে সংযম ও ভারসাম্য রক্ষা করাও জরুরি। কুরআন নির্দেশ দেয় যে, অতিরিক্ত উচ্চস্বরে কথা বলা যেমন অনুচিত, তেমনি অতিরিক্ত নিচু স্বরেও কথা বলা অনুপযুক্ত। ইসলামে সুষম ও মর্যাদাপূর্ণ বক্তব্যের গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
সংযম: ইসলামী জীবনধারার অপরিহার্য অনুষঙ্গ
সংযম শুধু ব্যক্তিগত জীবনের জন্যই নয়, বরং এটি সামাজিক জীবন, অর্থনীতি, আচার-আচরণ, উপাসনা এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী শিক্ষায় সংযমের মূল শিক্ষা হলো যেকোনো কাজে চরমপন্থা ও অতিরিক্ততা এড়িয়ে ভারসাম্য বজায় রাখা।
সংযম: জীবনযাত্রা ও উপাসনার ভারসাম্য
আমিরুল মুমিনিন ইমাম আলী (আ.) তাঁর পুত্র ইমাম হাসান (আ.)-কে এক প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশে বলেন:
"وَ اقْتَصِدْ یَا بُنَیَّ فِی مَعِیشَتِکَ وَ اقْتَصِدْ فِی عِبَادَتِکَ"
অর্থাৎ, "হে আমার সন্তান! জীবিকা নির্বাহে সংযম অবলম্বন কর এবং ইবাদতে মধ্যপন্থা অনুসরণ কর।"
এই উপদেশে, ইমাম (আ.) জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে—জীবিকা ও ইবাদতে—সংযমের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
সংযম ও সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহারের শিক্ষা
আর্থিক বিষয়ে, অপচয় করা যেমন নিন্দনীয়, তেমনই কৃপণতাও গ্রহণযোগ্য নয়। সম্পদশালীরা মনে রাখতে হবে যে, তাদের সম্পদ কেবল তাদের ব্যক্তিগত ভোগের জন্য নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি দায়িত্ব, যা গরিব-দুঃখীদের সেবা ও সহায়তার জন্য অর্পিত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ইমাম আলী (আ.) বলেন:
"إِنَّ اَللَّهَ فَرَضَ فِی أَمْوَالِ اَلْأَغْنِیَاءِ أَقْوَاتَ اَلْفُقَرَاءِ"
অর্থাৎ, "আল্লাহ ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের জীবিকা নির্ধারিত করে রেখেছেন।"
তিনি আরও বলেন, ধনীরা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং দরিদ্ররা আল্লাহর আশ্রিত। যদি ধনীরা তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে, তবে আল্লাহর কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হবে।
উপাসনায় সংযম: চরমপন্থা নয়, ভারসাম্য জরুরি
সংযম শুধু জীবিকাতেই নয়, ইবাদতেও মধ্যপন্থা অনুসরণ করা উচিত। অতিরিক্ত নফল ইবাদতে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলা এবং পরে উদাসীন হয়ে যাওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
এ কারণে ইসলামে সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান ভাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে:
1. একাংশ জীবিকার জন্য
2. একাংশ ইবাদতের জন্য
3. একাংশ বিশ্রামের জন্য
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে রাতের নিদ্রাকে তাঁর এক নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন:
"وَمِنْ آیَاتِهِ مَنَامُکُمْ بِاللَّیْلِ"
অর্থাৎ, "তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে এক হলো তোমাদের রাতের ঘুম।"
পোশাকে সংযম ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
ইমাম আলী (আ.) তাকওয়াবানদের সম্পর্কে বলেন:
"وَ مَلْبَسُهُمُ الِاقْتِصَادُ"
অর্থাৎ, "তাদের পোশাক সংযম ও পরিমিতির প্রতিচ্ছবি।"
ইসলামে পোশাকের তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে:
1. লজ্জাস্থান ও দেহের ত্রুটি ঢেকে রাখা
2. শরীরকে আবহাওয়ার প্রভাব থেকে রক্ষা করা
3. সৌন্দর্য ও শালীনতা বজায় রাখা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাট্যতায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি ঘর থেকে বের হওয়ার আগে পোশাক-আশাক ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের যত্ন নিতেন।
পবিত্র কুরআনে পোশাকের প্রতীকী অর্থ
কুরআনে পোশাককে বিভিন্ন গভীর অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
1. রাতকে পোশাক বলে অভিহিত করা হয়েছে:
"وَجَعَلۡنَا ٱلَّیۡلَ لِبَاسࣰا"
("আমি রাতকে তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ করেছি।")
2. স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে বলা হয়েছে:
"هُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ"
("তারা তোমাদের জন্য পোশাক, আর তোমরা তাদের জন্য পোশাক।")
3. তাকওয়াকে শ্রেষ্ঠ পোশাক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে:
"وَ لِبَاسُ التَّقْوَیٰ ذَٰلِکَ خَیْرٌ"
("তাকওয়ার পোশাকই উত্তম।")
তাকওয়া: আত্মার শ্রেষ্ঠ আবরণ
তাকওয়া মানব আত্মার জন্য সুরক্ষা, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। কুরআনে ‘তাকওয়া’ শব্দটি এবং এর বিভিন্ন রূপ ২৫০ বারেরও বেশি উল্লেখ করা হয়েছে, যা এর গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।
তাকওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো:
যে কাজগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সাহায্য করে, সেগুলো পালন করা
যেসব কাজ আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা
এমন সকল কাজ করা, যা মানুষের সম্মান বৃদ্ধি করে ও আল্লাহর নিকট তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে
উপসংহার
সংযম ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি, যা জীবিকা, ইবাদত, পোশাক ও সামাজিক জীবনযাপনে ভারসাম্য বজায় রাখার শিক্ষা দেয়।
আপনার কমেন্ট